প্রিন্ট এর তারিখঃ Dec 23, 2024 ইং || প্রকাশের তারিখঃ ২১ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ইং
তামিম ইকবাল রাজু, বরিশাল প্রতিনিধি
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়িয়ে ৩৫ করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন চাকরিপ্রার্থীরা। তাদের দাবির মুখে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত এ-সংক্রান্ত কমিটি ছেলেদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর এবং মেয়েদের ৩৭ বছর সুপারিশ করার গুঞ্জন উঠলেও অবশেষে তারা ছেলে মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে ৩৫ বছর সুপারিশ করেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই সুপারিশ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা। এই প্রতিক্রিয়াই কি শিক্ষার্থীদের মনের কথা? আসলে বয়সসীমা বাড়ানোর ইতিবাচক-নেতিবাচক দিক নিয়ে কী ভাবছেন তারা? এ বিষয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষার্থীর বক্তব আমরা জানবো। আসলেই কি ভাবছেন তারা!
এ বিষয়ে মত প্রকাশ করেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের রাফিউল ইসলাম ,বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে সরকারি এবং বেসরকারি চাকরিতে বয়সসীমা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের দেশে সাধারণত চাকরিতে প্রবেশের জন্য বয়সসীমা ৩০ বছরের মধ্যে নির্ধারিত থাকে। এই বয়সসীমা নিয়ে যুবসমাজে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, যা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং পেশাগত জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে।যুবসমাজ মনে করে, চাকরির বয়সসীমা কিছুটা শিথিল করা উচিত। বিশেষ করে যারা উচ্চশিক্ষা বা বিশেষ প্রশিক্ষণে সময় ব্যয় করেছেন, তাদের জন্য বয়সসীমা আরও কিছু বছর বাড়ানো যেতে পারে এবং করোনা মহামারিতে কিছু সময় পড়াশোনা সহ সকল কার্যক্রম স্থগিত ছিল, সেজন্য কিছু সময় বাড়ানো যৌক্তিক বলে মনে করি, তবে তা ৩৩ উর্ধে নয়।চাকরির ক্ষেত্রে যোগ্যতাকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে বয়সের সীমাবদ্ধতা কমিয়ে আনলে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ সুযোগ পেতে পারে।
রসায়ন বিভাগের হাসিবুর রহমান হাসিব বলেন, চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করা হচ্ছে এটা কে আমি যুক্তিযুক্ত মনে করি না। আমাদের দেশে জবের তুলনায় জব প্রত্যাশীদের সংখ্যা অনেক বেশি। সুতরাং একটা সরকারি জবের জন্য অনেক বেশি প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। যদি ৩৫ বছর বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে প্রতিযোগিতা আরো বাড়বে কারন সীটের সংখ্যা বাড়ছে না। ফলে বেকারের সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে। বয়স বৃদ্ধি না করে যদি পড়াশোনা আরো আগে শেষ করা যায় তাহলে সেটা বেশি ইফেক্টিভ হবে বলে মনে করি। এখন একটা ছেলের পড়াশোনা শেষ করতেই ২৫ বছর লেগে যাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশি লাগছে ফলে সে মাত্র ৪/৫ বছর সময় পাচ্ছে। কিন্তু পড়াশোনা যদি ২২/২৩ বছরের মধ্যে শেষ করা যেতো তাহলে সে বেশি সময় পেতো। অপরদিকে বেকারত্বের বোঝা বইতে হতো না। আমার মনে হয় বয়স বৃদ্ধি না করে জব ক্ষেত্র বৃদ্ধি করতে হবে। আর কোনো ভাবেই অবসরের সময় বৃদ্ধি করা যাবে না।
ইংরেজি বিভাগের রাকিন খান জানান, চাকরিতে প্রবেশের উপযুক্ত বয়স নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা সমাজ, অর্থনীতি এবং ব্যক্তির সক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। প্রতিটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, আর্থিক অবস্থা এবং কর্মসংস্থান ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে চাকরির জন্য নির্ধারিত বয়স ভিন্ন হয়। বাংলাদেশের মতো জনবহুল রাষ্ট্রে বেকারত্বের সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কোটা পদ্ধতির শিকার হয়ে অনেক প্রার্থী, যথাযথ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও, কাঙ্ক্ষিত চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং স্বৈরাচারের পতনের মাধ্যমে সাম্য প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ।
বর্তমানে, চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধি করার আন্দোলন বাংলাদেশে চলছে এবং এটি একটি যৌক্তিক দাবি। কোটা সংস্কার আন্দোলন (২০১৮), নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (২০১৮), কোভিড-১৯ মহামারি, এবং সাম্প্রতিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন (২০২৪) সময়গুলোতে শিক্ষার্থীদের সেশন গ্যাপ হওয়ার কারণে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধি করা উচিত। আমি এই দাবির সাথে সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করি এবং দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানাই।
তবে, দীর্ঘ মেয়াদে এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর, সেখানে তরুণদের একটি বড় অংশ বেকারত্বে ভুগছে। সরকারি চাকরির আকাঙ্ক্ষায় তরুণরা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় সৃজনশীল ও দক্ষতামূলক কাজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, গ্রাজুয়েশনের জন্য দীর্ঘ সময় ব্যয় করা হয়, যা প্রায়শই কেবল একটি সরকারি চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই সময়ে শিক্ষার্থীরা যে শিক্ষা গ্রহণ করে তা বাস্তব জীবনের সাথে খুব বেশি সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এবং তাই চাকরির প্রস্তুতি নিতে আলাদাভাবে পড়াশোনা করতে হয়। এই প্রক্রিয়া প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে চলতে থাকে এবং তারুণ্যের অপার সম্ভাবনা হারিয়ে যায়। এর ফলে অর্থনৈতিক মন্দা, মানসিক ও শারীরিক সমস্যা, সামাজিক অস্থিরতা, অপরাধপ্রবণতা, মাদকাসক্তি, পারিবারিক কলহ, মানবসম্পদের অপচয় এবং আত্মহত্যার মতো সমস্যার সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে বিয়ের ক্ষেত্রে তরুণরা অধিকাংশই চাকরির উপর নির্ভরশীল, সেখানে চাকরি পেতে দীর্ঘ অপেক্ষা করলে বিয়ে এবং পরিবার গঠনের ক্ষেত্রে দেরি হয়, যা হতাশা এবং অপরাধপ্রবণতা বাড়ায়।
একজন নাগরিককে ৩৫ বছরে চাকরি নয়, বরং ৩৫ বছরের মধ্যে পেশাগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার রোডম্যাপ গড়তে হবে। সর্বোচ্চ ২৩ বছরের মধ্যে গ্রাজুয়েশন শেষ করে যেন কর্মজীবনে প্রবেশ করা যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে বৈচিত্র্য ও পেশাগত সাম্য-মর্যাদা নিশ্চিত করার পাশাপাশি উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য যথেষ্ট সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী কৃষি ও প্রাণিসম্পদ কেন্দ্রিক কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। প্রযুক্তিগত দক্ষতা নিশ্চিতে কারিগরি শিক্ষায় পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিতে হবে এবং ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
সর্বোপরি, শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সততার সঙ্গে একজন পেশাজীবী নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, এবং সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণে কাজ করা নাগরিকের কর্তব্য।