প্রিন্ট এর তারিখঃ Dec 22, 2024 ইং || প্রকাশের তারিখঃ ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ইং
নাটোর বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে, রাষ্ট্রকে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি স্থানীয়দের।
মোঃ ইমরান আহমেদ।
নিজস্ব প্রতিবেদক নাটোর।
নাটোরের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বহু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, অথচ তাঁদের নাম তালিকায় যোগ করে সম্মানিত হয়ে যাচ্ছেন। এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি, যা গ্রামবাসীর মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। গ্রামবাসীরা সরকার ও প্রশাসনের কাছে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একযোগে আবেদন জানিয়েছেন।
বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় বহু ব্যক্তি এমনভাবে নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন,যাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না, এমন অভিযোগ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও গ্রামবাসীদের। তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নাম থাকায় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস যেমন বিকৃত হচ্ছে অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত বীরদের প্রতি অন্যায় হচ্ছে। এলাকাবাসীর মতে, এসব নাম ক্ষমতার প্রভাব বা রাজনৈতিক তদবিরের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ ব্যাপারে অনেকে অভিযোগ করে বলেন তৎকালীন সময় আবুল কামান্ডার মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করার জন্য ফরম বিক্রি করেছেন। কারো কাছ থেকে ১০ টাকা ২০ টাকা এমনকি ৫০ টাকার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের এমনই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন মোঃ আলী প্রধান, মোহাম্মদ সিটু, ইয়াজউদ্দিন, হাবু মোল্লা, কাদের, সহ অন্যান্যরা যাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা জানিয়েছেন তারা তৎকালীন সময়ে তাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাত খাইয়েছেন বিধায় তারা আবুল কমান্ডার ও মুক্তিযুদ্ধের ফরম বিক্রেতা হিসেবে এলাকায় পরিচিত আলী আকবর এর কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে ফর্ম কিনে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় জনগণের মাঝে রয়েছে চরম ক্ষোভ এবং হতাশা।
বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযুদ্ধা সাবেক পুলিশ সদস্য মজিদ আকন্দ বলেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রণাঙ্গনে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার আবুল হোসেন ফরম বিক্রি করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ভুক্ত করেছেন। তিনি বলেন যারা ১৯৭১ সালে জন্মগ্রহণই করেনি তাদেরকেও আবুল কমান্ডার ফরম বিক্রি করে মুক্তিযুদ্ধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন । ফরম বিক্রি করে এই সমস্ত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করার কারণে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও অর্জন আজ ম্লান হয়ে গিয়েছে।। টাকা দিয়ে ফর্ম কিনে মুক্তিযুদ্ধে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে তৎকালীন সময়ে আমি ফরম না কিনার কারণে আমাকে মুক্তিযুদ্ধের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
মজিদ আকন্দ আরো বলেন, সরকারের উচিত এই সমস্ত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত তালিকা তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত বীর সেনানিদের সম্মান দেওয়া।
বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা পরিবার এবং সাধারণ জনগণ দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানিয়ে আসছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এই কারণে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষুব্ধ এবং হতাশ। বিশেষ করে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগ করেছেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে তাঁদের মর্যাদা সংকুচিত হচ্ছে।
গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, "আমরা যুদ্ধের সময় আমাদের প্রাণ বাজি রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। কিন্তু এখন এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে আমাদের সম্মান নিচে চলে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের কাছে আমাদের আবেদন, অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন।"
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি
এলাকার জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা একসাথে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। তাদের মতে, এই পরিস্থিতি শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকেই বিকৃত করছে না, বরং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত বীরদের আত্মত্যাগ এবং তাদের পরিবারের সম্মানও ক্ষুণ্ন করছে।
স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি বলেন, "যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি, তারা যদি মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পান, তবে বাস্তব মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কী অবস্থা হবে? সরকারের উচিত দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই অবিচার নিরসন করা।"
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত নাটোর সদর উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আক্তার জাহান সাথী জানিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে যে কোনো অভিযোগের সত্যতা যাচাই এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
এক সাক্ষাৎকারে ইউএনও আক্তার জাহান সাথী বলেন, "ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে যদি মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা আসে, তাহলে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবের ইতিহাস, এবং এই মহান ত্যাগকে কেউ যেন কলুষিত করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
এদিকে, নাটোরের একটি স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, "আমরা এ বিষয়ে গভীরভাবে কাজ করছি এবং যত দ্রুত সম্ভব প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদের সন্তান প্রকৌশলী রানা হোসেন এক আবেগঘন বিবৃতিতে জানান, তাঁর পিতা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ পড়েছে। এ বিষয়ে তিনি গভীর হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
রানা হোসেন বলেন, “আমার পিতা মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছিলেন। কিন্তু আজ সেই অবদানকে অস্বীকার করা হয়েছে। আমরা আশা করি, আমার পিতার নাম যথাযথ যাচাই-বাছাই শেষে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।”
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাকে রক্ষা করতে হলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মর্যাদা প্রদানই হবে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধার নিদর্শন।
রানা হোসেনের মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আজ এই একই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। তাঁদের দাবি, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করার প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হওয়া উচিত।
এ বিষয়ে তিনি সরকারের কাছে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। তাঁর কথায়, “মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের জাতির গর্ব। তাঁদের সঠিক স্বীকৃতি না দিলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হবে। আমি আশা করি, সরকার এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।”
মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংশোধন ও যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে সরকারের কার্যক্রম কতটা কার্যকর হবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে রানা হোসেনের মতো ব্যক্তিদের আবেদন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এমন পরিস্থিতি শুধু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিকৃতি ঘটায় না, বরং জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস এবং হতাশা সৃষ্টি করে। যখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা যথাযথ সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার বঞ্চিত, তখন জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি আস্থা নষ্ট হতে পারে।
গ্রামবাসীরা বলেছেন, সরকার যদি এই সমস্যার দ্রুত সমাধান না করে, তাহলে এর ফলস্বরূপ নতুন ধরনের অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে। তাঁরা দাবি করছেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের প্রকৃত মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া উচিত এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
নাটোরের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানহানি এবং সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে জনমনে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। সরকার ও প্রশাসনের কাছে দাবি, এই অবিচার দূর করতে শীঘ্রই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হোক, যাতে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস রক্ষিত থাকে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবাররা যথাযথ সম্মান পায়।