প্রিন্ট এর তারিখঃ Dec 23, 2024 ইং || প্রকাশের তারিখঃ ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ইং
নুরুল ইসলাম
সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ, যেখানে স্বাধীনতার ৫০ বছরের ইতিহাস এক সম্প্রীতির ইতিহাস। এ দেশে অবস্থানরত হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এক পরিবারের মত মেলামেশা, নেই কোন ভেদাভেদ, রয়েছে এক সম্প্রীতির এক অন্যান্য দৃষ্টান্ত। যদিও গত ১৬ বছরে রাজনৈতিক সুবিধা ভোগের জন্য বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়কে বলির পাঠা করে এসেছিল একটি রাজনৈতিক দল। বিশ্বের কাছে ম্যাসেজ দিতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ সংখ্যালগুর অপনজন।তারা না থাকলে এ দেশে সংখ্যালগুর উপর নির্যাতন, নিপিড়ন শুরু হয়। তারা রাজনৈতিক ফায়দা লুট করতে সংখ্যালগুর উপর হামলা করে বিরোধী দলকে কোনঠাসা করত যা প্রতিনিয়ত ঘটতো কিন্তু ভারতের একনিষ্ঠ হওয়ায় তা নিয়ে তাদের কখনো মাথা ব্যাথা ছিল না। কিন্তু জুলাই অভ্যূত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারতের স্বার্থে আঘাত হতে শুরু করলে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে সাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে ভারতের মিডিয়ার অপপ্রচার শুরু করে। বাস্তবে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সংখ্যালগুর কোন নির্যাতন এ দেশে নেই।
১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ গত ৫ আগষ্ট ছাত্র জনতার অভ্যূত্থানের মাধ্যমে পতনের পর পরাজিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ এ দেশকে ব্যর্থ ও অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু ছাত্র জনতা এদেশের সর্বস্তরের জনগণ হিন্দু,মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেই।
কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমের মাধ্যমে পরাজিত শক্তি হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের মিথ্যা নিউজ প্রচার করে দুই দেশের মধ্যে একটি স্নায়ু যুদ্ধের সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলা,আগরতলা হাইকমিশনে হামলা করে বাংলাদেশের জনগণকে উস্কে দিয়ে বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর হামলা করার একটি অকৌশল চালিয়ে মুসলিম হিন্দুদের আলাদা করার প্রচেষ্টা চালায়।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংখ্যালগু নির্যাতন, ধর্মীয় সংঘাতের মিথ্যা সংবাদ প্রচার করছে। এই মিথ্যা সংবাদের সত্যতা কতটুকু?
অর্চন প্রভা দে বলেন, আমরা বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানে আছি। আমাদের দেশে কোন এমন ঘটনা ঘটেনি। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আমরা বসবাস করছি। এখানে কোন সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেনি। আমরা এখানে শান্তিভাবে আছি।
রনজিত কান্তি দে বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছি। এখানে কোন ঝামেলা নেই। সোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা কি বর্তমানের না পূর্বের তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে এখানে কোন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সমস্যা নেই।আমরা ভাল আছি।
কক্সবাজার খুরুশকুল উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত আমাদেরকে সাহায্য করেছে এটা যেমন সত্য ঠিক তেমনি বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে তখন ভারত আমাদের সাথে বিমাতা সুলভ আচরন করছে। আমাদের দেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এখানে সংখ্যালগু নির্যাতনের মত কোন ঘটনা ঘটেনি। আমরা অসাম্প্রদায়িক বাঙালি। আমরা এক পরিবারের মত পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ রেখেই বসবাস করছি। ভারতের মিডিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছে। তা কখনো কাম্য নই। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি সকল ধর্মের মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে। দেশের প্রয়োজনে আবারও আমরা হিন্দু মুসলিম লড়ব। এখানে কোন সাম্প্রতিকতার স্থান নেই।
কক্সবাজার জেলা রাস মন্দির পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক টিকলু বলেন, আমরা ভালো আছি। আমাদেরকে এখানে কেউ অশান্তি সৃষ্টি করছে না। তবে ভারতীয় মিডিয়া আমাদের দেশ নিয়ে যা প্রচার করচে তা কতটুকু সত্যি বলতে পারছিনা কারণ দেশে অতীতে যা হয়েছে তা সোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করছে নাকি বর্তমানে কিছু কুচক্রী মহল আমাদেরকে দেশে অশান্তি সৃষ্টি করার জন্য এসব হামলা করছে।এটা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা এখানে ভাল আছি।এখানে কোন সাম্প্রতিক হামলা হয়নি।
কক্সবাজারের সিনিয়র সাংবাদিক মোহাম্মদ আলম বলেন, প্রত্যেক মিডিয়ার উচিত সত্য জেনে তা প্রচার করা। বাংলাদেশে গত ১৬ বছর সাংবাদিকদের সত্য প্রকাশে কোন স্বাধীনতা ছিল না। এখন বাংলাদেশ সহ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উচিত সত্য তুলে ধরা। ভারত হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে কিন্তু আমার দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। তাই সকল বিশ্ব মিডিয়ার উচিত সত্য তুলে ধরে অপপ্রচার বন্ধ করা।
পরিসংখ্যানে দেখা যায় ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রচার কতটা গ্রহণযোগ্য। বিগত আওয়ামী লীগ শাসনে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে ১ হাজার ৪৫টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা-নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাগুলোর মধ্যে ৪৫টি হত্যাকাণ্ড, ৭টি মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা, ১০ জনকে হত্যার চেষ্টা, ৩৬ জনকে হত্যার হুমকি, ৪৭৯ জনকে হামলা বা নির্যাতন, ১১ জনের কাছে চাঁদা দাবি, ১০২টি হামলা বা ভাঙচুরের ঘটনা, ৪৭টি জমি দখলের ঘটনা, ৪৫টি দখল বা উচ্ছেদের হুমকির ঘটনা, ১১টি দেশত্যাগের হুমকি, ১৫টি দেবোত্তর সম্পত্তি দখলের চেষ্টা, ৭টি শ্মশানভূমি দখলের চেষ্টা, ১৪টি মন্দিরে হামলা, ৪০টি প্রতিমা ভাঙচুর, ২৫টি ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টা, ১২টি অপহরণ
২০১৮ সাল থেকে ৬ বছরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনার ৩০৭টি মামলায় চার্জশিট হয়েছে ১৭৯টির। বিচার সম্পন্ন হয়েছে ৭টির। এ ছাড়া ১৪টি মামলায় আসামিরা খালাস পান । কিন্তু জুলাই অভ্যূত্থানের পর বাংলাদেশে যে সম্প্রতি সহবস্থান তা অতীতের চেয়েও ভাল য্বখানে কোন সহিংসতার খবর নেই।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ, ছাত্রসমাজের ভূমিকা:
সাম্প্রদায়িকতা এক দুরারোগ্য ব্যাধি। এই ব্যাধির জীবাণু জাতির জীবনের গভীরে প্রোথিত। শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলার কঠোরতার মধ্যেই এর সমাধান সূত্র নেই। তরুণ শিক্ষার্থীরাই হল দেশের সবচেয়ে আদর্শপ্রবণ, ভাবপ্রবণ অংশ। ছাত্র-সমাজই দেশের ভবিষ্যৎ, জাতির কাণ্ডারী। তাদের মধ্যে আছে অফুরান প্রাণশক্তি। পারস্পরিক শ্রদ্ধার মনোভাব, আন্তরিক মেলামেশা, ভাবের আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় হবে এক নতুন প্রজন্মের। এরই মধ্য দিয়ে ছাত্ররা নতুন করে অনুভব করবে মানবতার উদার মহিমা। শুনবে সেই মহামিলনের মন্ত্র। ছাত্রাবস্থায়ই সাম্প্রদায়িকতার রাহু মুক্তির শপথ নিতে হবে। সম্প্রীতির মহাব্রত অনুষ্ঠানের তারাই হবে প্রধান পুরোহিত। শুধু পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়া নয়, সুকুমার বৃত্তিগুলো যথাযথ বিকশিত হলেই তাদের শিক্ষার পূর্ণতা, সার্থকতা। মনুষ্যত্বের অধিকার অর্জনই হবে তাদের শিক্ষানুশীলনের পরম প্রাপ্তি। শিক্ষার নিবেদিত প্রাঙ্গণে তারা নতুন করে উপলব্ধি করবে সবার উপরে মানুষই সত্য। মানুষে মানুষে প্রীতি-বন্ধনই হবে তার শেষ কথা।